ফিরে আসার গল্প-২ ভালোবাসার রঙিন মথ

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ২১ আগস্ট, ২০১৪, ০৯:৪৪:২৮ রাত



ব্রেক-আপ হয়ে গেলে কি মানুষ তাঁর নিজের থেকেও অনেক দূরে সরে যায়?

ইন্টারন্যাল অর্গানগুলোও কি তাঁর নিজের থাকে না? একজন বিচ্ছিন্ন মানুষের মতো তবে কেন লাগছে! যার নিজের অংগ-প্রত্যঙ্গগুলোও নিজের সাথে নেই, সে কীভাবে বেঁচে থাকে?

নিজের বুকের বামপাশে হাত দিলাম। আশ্চর্য্য হয়ে কোনো স্পন্দন অনুভব করলাম না। আর এটা অনুভবের সাথে সাথেই ভয় মেশানো এক বিচিত্র অনুভূতি আমাকে আবার সচল করে দিলো। এবার আর হাত দেবার প্রয়োজন হল না। নিজের বুকের ধুক ধুক শব্দ নিজে তো শুনতে পাচ্ছিই... আমার একটু উপরে বসে থাকা জুটিরাও শুনতে পেয়েছে বোধহয়। মৃত্যু ভীতি আমাকে আবার নবজীবন দিলো! একটু অবাক হই ... লজ্জাও লাগে নিজের কাছে।

এসেছিলাম মরতে।

আর সেই মৃত্যু ভয়েই ভীত হয়ে পড়লাম! যখন প্রথমবার হৃদস্পন্দন পেলাম না... সেকেন্ডের সহস্র ভগ্নাংশের ভিতরেই জেগে উঠেছিল ঐ অনুভূতি। এরপর বেঁচে থাকার আনন্দে সচল হওয়া হৃদয় নিয়ে এখন এক হৃদয়হীনার কাছ থেকে পাওয়া দুঃখকে উপভোগ করছি!

বসেছিলাম জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটির ভিসি’র বাসভবনের পশ্চিমের পুকুরঘাটে। সাথেই অফিসার্স ক্লাব। আমি পুকুরের শেষ সিঁড়িতে পানিতে পা ভিজিয়ে বসে আছি। আমার পিছনে বেশ কয়েক ধাপ উপরে এক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা বসে আছে। খুব আস্তে আস্তে ওরা কথা বলছিল। আর আমি ওদের চলে যাবার অপেক্ষায় আছি। সময় তখন শেষ বিকেল। আকাশ মেঘে ঢাকা। একটু পরেই নামবে সন্ধ্যা।আমি আমার দুই পা পানিতে ডুবিয়ে বসা। একটু বিরক্ত হচ্ছি জুটিটির ওপর। ওরা না গেলে তো মরতেও পারছিনা। ভাবলাম ওদেরকে কি গিয়ে বলব, ‘ দেখ, তোমরা কিছুক্ষণের জন্য এখান থেকে চলে যাও। আমাকে একটু একাকী মরতে দাও। এরপর যত পারো ফিসফিস করো।‘ কিন্তু বলা হল না। অনেক কিছু-ই তো মনের ভিতরে থেকে যায়... কাউকে বলা হয়না। যেভাবে পারিনি আজ দুপুরে আমার সাথে সব ছিন্ন করে মুনমুন চলে যাবার সময়। শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কেন?’ আমাদের এনগেজমেন্টের রিংটা খুলে আমার হাতের তালুতে ধরিয়ে দিয়ে কোনো কথা না বলে চলে গেলো। এটাই কি মুনমুনকে আমার শেষ স্পর্শ করা?

এই পুকুরে এক শিক্ষকের মেয়ে ডুবে মারা গিয়েছিল। ব্যাপারটা বেশ রহস্যজনক ছিল। আচ্ছা, সে কি আমাকে দেখছে? মৃত মানুষেরা কি মরতে যাওয়া মানুষকে দেখতে পায়? যদি পেতো সে এখন চোখ বড় বড় করে আমার দিকেই হয়তো তাকিয়ে আছে।

বড় বড় ফোটা নিয়ে বৃষ্টি বেশ জাঁকিয়ে বসলো। পড়ন্ত ফোটাগুলি আমার শরীরে তীব্র ব্যথার অনুভূতি জাগিয়ে তুললো। আমি এবারে একটু শব্দ করেই হাসলাম। যে লোক মরতে চলেছে, তাঁর আবার ব্যথার অনুভূতিও জাগে? ধীরে ধীরে পুকুরের পানিতে ধাপে ধাপে নামতে থাকলাম। শুনেছি মৃত্যুর পুর্বে নাকি সমস্ত জীবনের ছবিটা একে একে চোখে ভাসে। আমিও তেমন কিছু অনুভব করতে চেষ্টা করলাম। প্রথমেই আমার মায়ের কথা মনে পড়ল! তাঁর মুখটা সামনে আনার চেষ্টা করলাম। স্পষ্ট দেখতে পেলাম মাকে... প্রচন্ড বৃষ্টির ফোটা আমার চোখকে পুরোপুরি মেলতে দিচ্ছে না... তারপরও আমি সেই মায়াময় মুখটিকে দেখছি। এটা কি কোনো ধরণের হ্যালুসিনেশন? যা মৃত্যুর আগে প্রকৃতি আমাদেরকে দেখায়... আমাদের নিয়ে খেলা করতে চায়? নাকি প্রস্থানটিকে সহজ করার জন্য প্রিয় মুখগুলোকে দেখানোর চেষ্টা। আমি চোখ বন্ধ করে আমার শৈশব থেকে শুরু করে দেখতে দেখতে এই পুকুরের পানিতে বুক পর্যন্ত নিমজ্জিত অবস্থায় ফিরে এলাম। আর আশ্চর্য হয়ে অনুভব করলাম সেখানে একবারের জন্যও আমি মুনমুনকে দেখতে পেলাম না।

কেউ কেউ চাঁদনি পশর রাতে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চায়। তাঁদের মনে কেন এই ইচ্ছেটা জাগে তা আমি অনুভব করতে না পারলেও এখনকার এই আঁধার -কালো বৃষ্টিমুখর ভরা সাঝের বেলায় চলে যাওয়াটাও মন্দ নয়। আমি আরো একটু এগিয়ে সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছালাম। এরপর? এরপর আমি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবো। আমি আমার জীবনের শেষ ধাপকে অতিক্রম করলাম। আমার গলা পর্যন্ত এসে মৃত্যু আমার দিকে চেয়ে রইলো। শেষবার চোখ মেলে চারদিকটা দেখে নিলাম! বুক ভরে এই পৃথিবীর বাতাসকে উপভোগ করলাম। আর ঠিক তখনি কোথা থেকে একটি রঙিন মথ আমার আধবোজা চোখের সামনে দিয়ে উড়ে এলো।

গোলাপি আভা ডানায় নিয়ে সেই হলুদ মথটি চোখের সামনে কিছুক্ষণ ঊড়ে বেড়ালো। খুব কাছে আমার... এরপর পুকুর পাড়ের রঙিন ফুল গাছগুলোর দিকে উড়ে গেলো। সেখানে ওর অপেক্ষায় নিজেদেরকে মেলে ধরা ফুলগুলোর রেণুতে গিয়ে সে বসলো। এক ফুল থেকে অন্য ফুলে তাঁর স্বভাবজাত চাঞ্চল্য নিয়ে উড়ে উড়ে নতুন জীবনের গান গেয়ে চললো।

আমি ফিরে এলাম। এক এক ধাপ পিছনে ফিরছি আর জীবনের দিকে এক এক ধাপ এগিয়ে যাচ্ছি। এভাবে সব গুলো ধাপ পেরিয়ে আমি জীবনের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে গেলাম। ততক্ষণে আমি নিজেও সেই রঙিন মথটির মত ভালোবাসায় পুর্ণ এক মথে পরিণত হয়েছি। ওর মতো এক ফুল থেকে অন্য ফুলে উড়ে বেড়ানোর চেতনা অনুভব করলাম। জীবনটা খুব সুন্দর! তবে একে শুধু নিজের জন্য ভেবে সময়ক্ষেপন করলে হবে না। জীবনের জন্য জীবনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ঠিক ঐ রঙিন মথটির মতো। সে পরাগায়নে সাহায্য করছে, একই সাথে নিজের জন্য প্রয়োজনীয় মধুও আহরন করছে। যার ফলে এই পৃথিবীটা এতো সুন্দর আমাদের চোখে।

একটা অন্ধকার গুহা থেকে বের হতেই হাজার সুর্য্য রশ্মির আলোকে আমি উদ্ভাসিত হলাম! সকল কষ্ট-ঘৃণাকে আমি গুহার ভেতর ফেলে ভালোবাসায় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে এসেছি। আমার অপেক্ষায় সকল ফুলেরা... একটি রঙিন মথ হয়ে ওদের ভিতর ভালোবাসা বিলিয়ে দিতে বৃষ্টির ভিতর দিয়ে জীবনের দিকে এগিয়ে গেলাম।। Rose

বিষয়: বিবিধ

১৬২৬ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

256872
২১ আগস্ট ২০১৪ রাত ০৯:৫১
সন্ধাতারা লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ খুব ভালো লাগলো লিখাটি
২১ আগস্ট ২০১৪ রাত ০৯:৫৬
200511
মামুন লিখেছেন : আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ। Happy
256878
২১ আগস্ট ২০১৪ রাত ১০:১৫
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
২১ আগস্ট ২০১৪ রাত ১১:২২
200551
মামুন লিখেছেন : ধন্যবাদ আপনাকেও। Happy
256893
২১ আগস্ট ২০১৪ রাত ১০:৪৭
আজিম বিন মামুন লিখেছেন : অসাধারন ধন্যবাদ দিলাম,অসাধারন লেখার জন্য।
২১ আগস্ট ২০১৪ রাত ১১:২৪
200554
মামুন লিখেছেন : শুনে অনেক ভালো লাগলো। আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা।Good Luck
256927
২২ আগস্ট ২০১৪ রাত ১২:৪৭
বৃত্তের বাইরে লিখেছেন : অনেক সময় এমন অনেক পরিস্থিতি আসে যখন স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করাটাকে মানুষ সহজ মনে করে। কেউ করে আবেগে, কেউ বাধ্য হয়ে। তবে এমন সিদ্ধান্তে যাওয়াটা কাপুরুষতা । আপনার ফিরে আসার গল্পটা নবজীবন লাভ করার মত আনন্দের। খুব ভাল লাগল। ধন্যবাদ আপনাকে Good Luck Rose Good Luck
২২ আগস্ট ২০১৪ রাত ০১:১২
200597
মামুন লিখেছেন : আপনার নান্দনিক মন্তব্যের জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা রইলো।Good Luck
256940
২২ আগস্ট ২০১৪ রাত ০১:২৪
বাজলবী লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ।
২২ আগস্ট ২০১৪ রাত ০১:৩৩
200598
মামুন লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা HappyGood Luck
256979
২২ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৬:৪০
রাইয়ান লিখেছেন : [b]একটি রঙিন মথ হয়ে[/b....
অসাধারণ সুন্দর লেখা.... অনেক ধন্যবাদ আপনাকে !
২২ আগস্ট ২০১৪ সকাল ১০:০৭
200678
মামুন লিখেছেন : আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ, শুভেচ্ছা রইলো, নিরন্তর। Happy
256989
২২ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৮:২৮
কাহাফ লিখেছেন : আশা জাগানিয়া লেখা,এগিয়ে যাওয়ার অণুপ্রেরণায় ভরপুর,ধন্যবাদ আপনাকে.........।
২২ আগস্ট ২০১৪ সকাল ১০:০৯
200679
মামুন লিখেছেন : হ্যা, এই সময়ে 'আশা-ই'আমাদের একমাত্র ভেলা। ধন্যবাদ আপনাকে।Good Luck
257006
২২ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৯:৩২
বুড়া মিয়া লিখেছেন : ভালো লাগলো
২২ আগস্ট ২০১৪ সকাল ১০:১০
200680
মামুন লিখেছেন : আপনার ভালো লাগা আমার অনুপ্রেরণা। ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File